‘সোসাল নেটওয়ার্কিং’ এই শব্দবন্ধটি বিগত কয়েক বছরে
শুধুমাত্র উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারকারী ধনী, গণশিক্ষার হারে এগিয়ে থাকা দেশগুলিতেই
নয় অপেক্ষাকৃত উন্নত প্রযুক্তির সার্বিক স্পর্শ
বঞ্চিত গরীব,শিক্ষার হারে পিছিয়ে থাকা মানুষের জাতীয় জীবনকে সবার্থে নাড়া
দিতে সক্ষম হয়েছে। ইন্টারনেট ও মোবাইল প্রযুক্তি জনমত গঠন, সংগঠিত ও স্বতঃস্ফুর্ত
প্রতিবাদের এক নতুনধারার জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছে। মতামত প্রকাশ, সমমতালম্বী
মানুষকে খুঁজে পাওয়া, সংঘবদ্ধ হওয়া এবং লক্ষ্যে পৌঁছে আবার পূর্ববর্তী ভূমিকায়
বিলীন হয়ে যাওয়ার অদ্ভুত মঞ্চ তৈরী হয়েছে। কিন্তু মজার বিষয় হল মিডিয়া ও
প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা কেউই বোধহয় এই মঞ্চায়িত হয়ে চলা ঘটনাগুলির নীরব
দর্শক হয়ে থাকতে পারিনি। আমরা নয়তো এতে সামিল হয়েছি। সোসাল নেটওয়ার্কিং সাইটে,
ওয়েব ফোরামে ‘like’, ‘share’ করে বা ব্লগে বিতর্কে সামিল হয়ে অথবা সামিল হয়ে অথবা
অজান্তেই নিজেকে প্রস্তুত করেছি ভবিষ্যাতের লড়াইতে সামিল হতে।
আমার ব্যক্তিগত ধারনায় গনতন্ত্র এক নতুন আঙ্গিক
পেয়েছে এই নতুন ধারার সোসাল নেটওয়ার্কিং ভিত্তিক কার্যক্রমে। এই কার্যক্রম
নাগরিককে তার মতপ্রকাশ ও প্রচার এবং সেই মত সহনাগরিকদের মতামতের আলয় যাচাই করে
নেওয়ার এক অভূতপুর্ব সুযোগ দিয়েছে এবং আমরা তা গ্রহন করেছি সর্বান্তকরনে। তাই “আরব
বসন্ত”এর বাতাস রক্ষণশীল ভারতীয় সমাজের পাশে,বাধ্য করেছে তাকে “নারীর” অধিকার ও
সুরক্ষা নতুন করে ভাবতে। পুর্বে ঘটে যাওয়া সামাজিক,রাজনৈতিক গণআন্দোলন গুলির থেকে
এর চরিত্র যেমন আন্দোলন শুধু ওয়েব দুনিয়ার ভারচুয়াল মঞ্চেই থেমে যায়নি, নেমে এসেছে
রাজপথে,গলিতে – লাঠি,গুলি,বোমায় নিজেকে রক্তাক্ত করে বনিয়াদ গড়তে চেয়েছে নতুন
সমাজের। তাই যারা এই সোসাল নেটওয়ার্কিং-এ প্রত্যক্ষ সামিল হতে পারেনি বা চায়নি,
তারাও কিন্তু সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে সামিল হয়েছে। মতের আদানপ্রদান গনতন্ত্রের
আঙ্গিনা অনেকখানি বিস্তৃত হয়েছে। প্রতিনিধিত্বমূলক গনতন্ত্রের নিয়মতান্ত্রিক
“তাসের দেশে” হঠাৎ যেন ‘নতুন যৌবানের দূত’ এসেছে। গ্রীক নগররাষ্ট্রের আস্বাদ যেন আমরা
পেতে শুরু করেছি নিয়মতান্ত্রিকতার বেড়াজালের মধ্যেই।
ফেব্রুয়ারি ২০১৩-এর বাংলাদেশে সোসাল নেটওয়ার্কিং ও
গনতন্ত্রের এই নতুন সম্পর্ক আরেক ধাপ এগোল আন্দোলনকারীদের “দাবি”-এর মানবিক ভিত্তির
ওপর নির্ভর করে। তারা এমন এক মুক্ত সমাজের দাবি জানিয়েছে যা যেকোনো স্বাধীনতাকামী
মানুষের চিরকালের স্বপ্ন। তাদের এমন এক গণতান্ত্রিক মুক্ত সমাজের যেখানে ব্যষ্টির
নিজ বিশ্বাস,জীবনপদ্ধতি সমষ্টির সামগ্রিক চাওয়ার কাছে মাথানত করে। এই স্বাধীন
সমাজ যা ব্যষ্টির ও সমষ্টির মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপন করে। এই দাবিই সোসাল
নেটওয়ার্কিংকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংগঠিত আন্দোলনকে
গনতন্ত্রের প্রকৃত বাস্তব ভিত্তি দিতে চেয়েছে – গনতন্ত্রের জন্যই গনতান্ত্রিক
আন্দোলন, যদিও তা আহত,রক্তাক্ত ও নিহত হয়ে চলেছে প্রতিমূহুর্তে গনতন্ত্রদমনকারী
মৌলবাদের দ্বারা। তবু আশা এই বিপন্ন সময়ে এই নতুনধারার আন্দোলন হয়তো আমাদের সন্ধান
দেবে “মুক্ত”সমাজ গঠনের পথের।